গোলাগুলির দিন ডাইনিং টেবিলেই বসেছিলেন মা, নিহত ছেলেকে শেষ বিদায়ও জানাতে পারেননি
- ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার রতনপুর গ্রামের জাহিদুজ্জামান তানভীন (২৬)। রাজধানীর উত্তরা আজমপুরে পরিবারসহ বসবাস করতেন তিনি। বাবা ইঞ্জিনিয়ার মো. শামসুজ্জামান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অটোক্যাড অপারেটর হিসেবে কর্মরত এবং মা বিলকিস জামান একজন গৃহিণী। বড় বোন উচ্চশিক্ষার জন্য বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৮ জুলাই তানভীন প্রতিদিনের মতো সকালবেলা বাসা থেকে বের হন। আন্দোলনের সময় আজমপুরে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়, যেখানে দুপুর ১টা ১৩ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তার মৃত্যু শুধু পরিবার নয়, গোটা জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। পরিবারের ভাষ্যমতে, তানভীন ছিলেন পড়াশোনায় মেধাবী ও প্রযুক্তিনির্ভর এক দেশপ্রেমিক তরুণ, যিনি স্বপ্ন দেখতেন পরিবর্তনের।
তানভীন গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করেন ২০২২ সালে। এরপর তিনি তিন বন্ধুকে নিয়ে ‘অ্যান্টস’ নামে একটি ড্রোন নির্মাণ ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন চিফ টেকনিক্যাল অফিসার। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছে এবং প্রযুক্তিনির্ভর সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তার মেধা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত ছিল—নাসা আয়োজিত ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জে তিনি এশিয়ার মধ্যে প্রথম ও বিশ্বে দশম স্থান অর্জন করেন। বুয়েট, আইইউটি ও যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউশন অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতেছেন তিনি ও তার দল। একসময় বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ড প্রতিযোগিতায় ১০ লাখ টাকা অনুদান পেয়ে প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন তানভীন। তার মা বলেন, “প্রতিদিন দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে বিদায় দিতাম, সেদিন কেন যেন উঠতে পারিনি... আজও তার মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।”
তানভীনের মৃত্যুর পর তার বন্ধু ও ‘অ্যান্টস’-এর সিইও তাওসিফুল ইসলাম বলেন, “তানভীন ছাড়া এই প্রতিষ্ঠান দাঁড়াত না। সে শুধু ভালো ইঞ্জিনিয়ার নয়, একজন সৎ ও উদ্যমী মানুষও ছিল।” বর্তমানে ‘অ্যান্টস’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি, কৃষি অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে। তার স্বপ্ন ছিল—দেশেই থেকে দেশকে এগিয়ে নেওয়া। মৃত্যুর পর তার এলাকাবাসী পাঁচমাথা মোড়ের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ তানভীন চত্বর’ রাখে। সেখানে রোপণ করা হয়েছে দুটি গাছ—তানভীনের স্বপ্ন ও চেতনার প্রতীক হিসেবে। প্রযুক্তির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শুধু নিভেই যায়নি, বরং তার রক্তে জেগে উঠেছে এক নতুন প্রজন্ম, যারা বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখবে, যেখানে প্রতিভার কোনো গুলি নয়—স্বীকৃতি থাকবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন