নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগিং—বাবা-মা নিয়ে গালি, প্রোপোজ করানো হয়েছে ‘আপুদের’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরুর প্রথম সপ্তাহেই র্যাগিংয়ের অভিযোগে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। বিভাগটির একাধিক নবীন শিক্ষার্থী সিনিয়রদের বিরুদ্ধে চরম মানসিক নির্যাতন, গালাগাল, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং অপমানজনক আচরণের অভিযোগ তুলেছেন। অভিযোগকারীদের ভাষ্যমতে, পরিচয় পর্বের আড়ালে রীতিমতো একটি পরিকল্পিত র্যাগিং কালচারের মুখোমুখি হয়েছেন তারা। কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, কেউ ক্যাম্পাস ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এমনকি অভিযোগ রয়েছে, নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে ‘তালতলা’ নামক জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছে, অশ্লীল গালাগাল করা হয়েছে এবং পরিবার নিয়েও অবমাননাকর কথা বলা হয়েছে। ঘটনাগুলোতে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে বিভাগের সিআর এবং কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে—যাদের মধ্যে মো. ওয়ালি উল্লাহ, রাফিও হাসান, অরবিন্দু সরকার, মোনতাসীর বিল্লাহ এবং দুই সিনিয়র ছাত্রী রয়েছেন।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্যে উঠে এসেছে একের পর এক লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। এক শিক্ষার্থী জানান, ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভের (সিআর) মাধ্যমে তাকে রাতে ডেকে পাঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নির্জন এলাকায়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন তিনজন সিনিয়র শিক্ষার্থী। সেখানে তিনি ও তার বন্ধুদেরকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করা হয় এবং মোবাইল ফোন রেখে জোর করে আটকে রাখা হয় রাত ১টা পর্যন্ত। পরের দিন একই কৌশলে আবারও ডেকে নেওয়া হয় এবং তাদের ছবি তুলে হুমকি দেওয়া হয়। অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, তাকে সিগারেট খেতে বাধ্য করা হয় এবং বলা হয়, “তোরে দেখতে গাঁজাখোরের মতো লাগে।” এমনকি তাকে জোর করে এক সিনিয়র আপুকে কল দিয়ে প্রপোজ করতে বলা হয়। বিল্লাল হোসেন নামের আরেক নবীন শিক্ষার্থী জানান, সিনিয়রদের আচরণে এক মেয়ে কেঁদে ফেলায় তিনি প্রতিবাদ করেন, যার জেরে তাকেও গালাগাল, বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে অপমান এবং বারবার সালাম দিতে বাধ্য করা হয়। এমন ভীতিকর পরিস্থিতিতে কেউ কেউ আত্মরক্ষার জন্য ক্যাম্পাস ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। একজন শিক্ষার্থী নারায়ণগঞ্জে নিজ বাড়িতে ফিরে যান, তবে দুদিন পর ক্যাম্পাসে ফিরে আবারও হুমকির মুখে পড়েন নজরুল হলের ১০৯ নম্বর রুমে।
অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা অবশ্য নিজেদের নির্দোষ দাবি করছেন। মো. অলি উল্লাহ বলেন, “আমি শুধু চা খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম।” অরবিন্দু সরকারের বক্তব্য, “আমরা গেটে দেখা হলে চা খেতে বলেছিলাম, কাউকে র্যাগ দিইনি।” তবে শিক্ষার্থীরা তাদের বক্তব্যে অনড়—তালতলায় র্যাগিং চলাকালীন এদের উপস্থিতি ছিল এবং তারা নিজে থেকেই গালাগাল করেছেন বলে অভিযোগ করেন। একইসাথে, রিপোর্টারের কাছে থাকা ১৩ মিনিটের অডিও রেকর্ডে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এক সিনিয়র ছাত্রী বলেন, “সব অভিযোগ ভিত্তিহীন, কেউ কিছু বলে দিয়েছে।” কিন্তু ভুক্তভোগীদের মতে, বারবার অস্বীকার করে পরিস্থিতি আড়াল করার চেষ্টা চলছে। বিষয়টি নিয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক শামীমা নাসরিন বলেন, “র্যাগিং প্রতিরোধে প্রশাসনিক নীতিমালার আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হাকিমও দ্রুত বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে আলোচনা ও অ্যাকাডেমিক মিটিংয়ে উত্থাপনের কথা জানান। শিক্ষার্থীরা এখন চাইছেন একটি নিরাপদ, সম্মানজনক পরিবেশ—যেখানে তারা ভীত নয়, স্বাধীনভাবে উচ্চশিক্ষা নিতে পারবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন